রোমানিয়া ভিসা পেতে চাইলে কিছু নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বিশেষ করে যারা কাজ, পড়াশোনা, পর্যটন বা অন্য কোনো কারণে রোমানিয়ায় যেতে চান। এই নিবন্ধে আমরা রোমানিয়া ভিসা আবেদনের ধাপগুলো, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো।
পোষ্টের আলোচ্য বিষয়সমূহ:
রোমানিয়া ভিসার ধরন
রোমানিয়া ভিসা বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিভক্ত। আপনার ভ্রমণের উদ্দেশ্য অনুযায়ী বিভিন্ন ধরণের ভিসা রয়েছে। নিচে কিছু সাধারণ ভিসা ক্যাটাগরির তালিকা দেওয়া হল:
১. ট্যুরিস্ট ভিসা (Short Stay Visa – Type C)
রোমানিয়ায় ভ্রমণের জন্য ট্যুরিস্ট ভিসা সবচেয়ে জনপ্রিয়। আপনি ৯০ দিনের জন্য এই ভিসার অধীনে থাকতে পারবেন। এর জন্য দরকার হবে:
- পাসপোর্ট (অন্তত ৬ মাসের মেয়াদ)
- ব্যাংক স্টেটমেন্ট (অন্তত ৩ মাসের)
- হোটেল বুকিং এবং ভ্রমণের পরিকল্পনা
- বিমানের টিকেট
- স্বাস্থ্যবীমা
২. বিজনেস ভিসা (Business Visa)
যদি আপনার রোমানিয়ায় ব্যবসায়িক কোনো মিটিং, কনফারেন্স বা অন্য কোন ব্যবসায়িক কাজে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, তবে বিজনেস ভিসার প্রয়োজন হবে। এই ভিসার অধীনে আপনি ৯০ দিনের জন্য অবস্থান করতে পারবেন। দরকারি ডকুমেন্টসের মধ্যে রয়েছে:
- বিজনেস আমন্ত্রণপত্র
- কোম্পানি থেকে এনওসি (No Objection Certificate)
- ট্রেড লাইসেন্স এবং অন্যান্য প্রমাণপত্র
৩. স্টুডেন্ট ভিসা (Long Stay Visa – Type D)
যদি আপনি রোমানিয়ায় শিক্ষার জন্য যেতে চান, তবে আপনাকে স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। এই ভিসার মেয়াদ দীর্ঘমেয়াদী, সাধারণত এক বছরের জন্য হয় এবং কোর্স অনুযায়ী নবায়নযোগ্য। আবেদনের জন্য প্রয়োজন হবে:
- রোমানিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাডমিশন লেটার
- স্বাস্থ্যবীমা
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফি জমাদানের প্রমাণ
৪. ওয়ার্ক ভিসা (Work Visa)
রোমানিয়ায় কাজ করতে গেলে ওয়ার্ক ভিসার প্রয়োজন হবে। এই ভিসার জন্য আপনাকে রোমানিয়ার কোনও কোম্পানি থেকে চাকরির অফার লেটার প্রদান করতে হবে। এর জন্য:
- ওয়ার্ক পারমিট
- কোম্পানির নিয়োগপত্র
- পাসপোর্ট কপি
৫. ফ্যামিলি রিইউনিফিকেশন ভিসা (Family Reunification Visa)
পরিবারের সদস্যদের জন্য যারা ইতিমধ্যে রোমানিয়ায় আছেন।
রোমানিয়া ভিসা আবেদনের প্রক্রিয়া
১. অনলাইনে আবেদন:
প্রথম ধাপ হল রোমানিয়ার সরকারী ভিসা আবেদন পোর্টালে (eVisa Romania) গিয়ে আবেদন ফর্ম পূরণ করা। আবেদনটি সাবমিট করার পর আপনার কাছে একটি রেফারেন্স নম্বর আসবে যা ভবিষ্যতে আপনার ভিসার অবস্থা ট্র্যাক করতে কাজে লাগবে।
২. প্রয়োজনীয় কাগজপত্র:
রোমানিয়া ভিসার জন্য কিছু নির্দিষ্ট কাগজপত্র প্রয়োজন। নিচে তালিকাটি দেওয়া হলো:
- পূর্ণাঙ্গ আবেদন ফর্ম (অনলাইনে পূরণ করতে হবে)
- বৈধ পাসপোর্ট (যার মেয়াদ কমপক্ষে ৬ মাস থাকতে হবে)
- পাসপোর্ট সাইজের ছবি (সাম্প্রতিক)
- রিটার্ন টিকিটের কপি
- হোটেল বুকিং বা থাকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত প্রমাণ
- ভ্রমণের উদ্দেশ্য সম্পর্কিত চিঠি বা দলিল (যেমন কাজের অফার লেটার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি চিঠি)
- ভিসা ফি জমার রসিদ
৩. সাক্ষাৎকার:
আপনার আবেদন ও কাগজপত্র যাচাই করার পর, রোমানিয়ান দূতাবাস বা কনস্যুলেট আপনাকে একটি সাক্ষাৎকারের জন্য ডেকে নিতে পারে। সাক্ষাৎকারে আপনার ভ্রমণের উদ্দেশ্য এবং ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে আলোচনা করা হতে পারে।
৪. ভিসা ফি:
রোমানিয়া ভিসার ফি আবেদনকারীর ভিসার ধরন ও মেয়াদের ওপর নির্ভর করে। সাধারণত টুরিস্ট ও স্টুডেন্ট ভিসার জন্য ভিসা ফি ৬০-১০০ ইউরো হতে পারে।
৫. আবেদন প্রক্রিয়ার সময়:
রোমানিয়া ভিসা আবেদনের সময়সীমা সাধারণত ১০ থেকে ১৫ কার্যদিবস। তবে এটি আপনার ভিসার ধরন ও দূতাবাসের কাজের চাপের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে।
আরো জানুন: পাপুয়া নিউগিনি কাজের ভিসা ও বেতন সম্পর্কে
রোমানিয়া বেতন কেমন
রোমানিয়ায় বেতনের হার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চাকরির ধরণ, অভিজ্ঞতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অবস্থান অনুসারে পরিবর্তিত হয়। তবে সামগ্রিকভাবে, রোমানিয়ার বেতন অনেক ইউরোপীয় দেশের তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম হলেও, দেশটির অর্থনীতির অবস্থান অনুসারে এটি যথেষ্ট সাশ্রয়ী জীবনযাপন করতে সহায়ক।
রোমানিয়ায় গড় বেতন:
রোমানিয়ার গড় মাসিক বেতন ২০২৪ সালের হিসাবে প্রায় ১,২০০ – ১,৫০০ ইউরো (সাধারণত ট্যাক্স বাদে) হয়ে থাকে। এটি কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হতে পারে এবং বেসরকারি খাতের উচ্চ বেতনভুক্ত পেশাগুলি যেমন প্রযুক্তি, ব্যাংকিং এবং স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এর পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে।
বিভিন্ন পেশার বেতন:
নিচে বিভিন্ন পেশার গড় মাসিক বেতনের একটি ধারণা দেওয়া হলো:
- তথ্যপ্রযুক্তি (IT) ও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার: ২,০০০ – ৪,০০০ ইউরো
- ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী: ১,৫০০ – ৩,৫০০ ইউরো
- শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ: ৭০০ – ১,২০০ ইউরো
- ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনা: ২,০০০ – ৩,৫০০ ইউরো
- পর্যটন ও হোটেল ম্যানেজমেন্ট: ৮০০ – ১,৫০০ ইউরো
- ম্যানুফ্যাকচারিং ও ফ্যাক্টরি কাজ: ৫০০ – ১,২০০ ইউরো
ন্যূনতম বেতন:
রোমানিয়ায় ২০২৪ সালের হিসাবে ন্যূনতম বেতন প্রায় ৭০০ – ৮০০ ইউরো মাসিক (ট্যাক্স বাদে)। যদিও এই বেতন মূলত নিম্ন বেতনের কাজগুলিতে যেমন নির্মাণ, পরিষেবা খাত এবং কৃষিতে দেখা যায়।
বেতন বৃদ্ধির সুযোগ:
রোমানিয়ায় অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং ভাষা জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে বেতন দ্রুত বাড়তে পারে। ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ বা জার্মান ভাষার উপর ভালো দখল থাকলে, আপনি অনেক ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুযোগ পাবেন, যা উচ্চ বেতন পাওয়ার সম্ভাবনাও বাড়িয়ে দেয়।
কর ব্যবস্থা:
রোমানিয়ায় বেতনের উপর ১০-১৬% কর ধার্য করা হয়, যা ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম।
জীবনযাত্রার খরচ:
রোমানিয়ার জীবনযাত্রার খরচ তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী। বুখারেস্টের মতো বড় শহরে জীবনযাত্রার খরচ বেশি হলেও অন্যান্য শহরগুলোতে ভাড়া এবং দৈনন্দিন খরচ অপেক্ষাকৃত কম।
রোমানিয়া যেতে কত টাকা লাগে
রোমানিয়া যেতে কত টাকা লাগবে তা নির্ভর করে আপনার ভ্রমণের উদ্দেশ্য, ভিসার ধরন, থাকার জায়গা, বিমান টিকেট এবং অন্যান্য খরচের উপর। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ খরচের ধারণা দেওয়া হলো:
১. ভিসা ফি:
রোমানিয়া ভিসার জন্য সাধারণত নিম্নলিখিত ফি প্রযোজ্য হয়:
- ট্যুরিস্ট/শর্ট স্টে ভিসা (C টাইপ): প্রায় ৬০ – ৮০ ইউরো (প্রায় ৭,০০০ – ৯,০০০ টাকা)
- লং স্টে ভিসা (D টাইপ): ১২০ ইউরো পর্যন্ত হতে পারে (প্রায় ১৪,০০০ টাকা)
২. বিমান টিকেট:
ঢাকা থেকে রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে সরাসরি ফ্লাইট নেই। তবে এক বা একাধিক স্টপওভার সহ ফ্লাইট পাওয়া যায়। ফ্লাইটের খরচ সাধারণত ৪৫,০০০ – ৮০,০০০ টাকার মধ্যে হতে পারে, সময় এবং এয়ারলাইন্সের উপর নির্ভর করে।
৩. থাকার খরচ:
রোমানিয়ায় থাকার খরচ আপনার অবস্থান এবং হোটেল বা অ্যাপার্টমেন্টের ধরণ অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়:
- হোস্টেল/বাজেট হোটেল: প্রতিদিন প্রায় ৩০ – ৫০ ইউরো (৩,৫০০ – ৬,০০০ টাকা)
- মিড-রেঞ্জ হোটেল: প্রতিদিন ৫০ – ১০০ ইউরো (৬,০০০ – ১২,০০০ টাকা)
- এয়ারবিএনবি বা অ্যাপার্টমেন্ট: প্রতিদিন ৪০ – ৮০ ইউরো (৪,৮০০ – ৯,৬০০ টাকা)
৪. দৈনন্দিন খরচ:
দৈনন্দিন খরচ যেমন খাবার, যাতায়াত এবং বিনোদনের জন্য প্রতিদিন প্রায় ২০ – ৫০ ইউরো (২,৪০০ – ৬,০০০ টাকা) লাগতে পারে। রোমানিয়ায় রেস্তোরাঁয় খাবারের খরচ সাধারণত সাশ্রয়ী।
৫. স্বাস্থ্যবীমা:
রোমানিয়ায় ভ্রমণের জন্য স্বাস্থ্যবীমা বাধ্যতামূলক। এটি সাধারণত ১০ – ২০ ইউরো (প্রায় ১,২০০ – ২,৪০০ টাকা) লাগতে পারে।
৬. অন্যান্য খরচ:
- পরিবহন: পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বেশ সাশ্রয়ী, একটি বাস বা মেট্রো টিকিটের খরচ প্রায় ১ – ২ ইউরো (১২০ – ২৪০ টাকা)।
- শপিং এবং অন্যান্য খরচ: আপনি যদি কেনাকাটা বা অন্যান্য বিনোদনে আগ্রহী হন তবে অতিরিক্ত খরচ যোগ হতে পারে।
মোট খরচের অনুমান:
- সাধারণ ট্যুরিস্ট ভ্রমণ (১ সপ্তাহ): প্রায় ১,৫০,০০০ – ২,০০,০০০ টাকা।
- লম্বা সময় থাকার জন্য (মাসিক খরচ): যদি শিক্ষার জন্য বা কাজের জন্য যান, তাহলে মাসিক খরচ প্রায় ১,০০,০০০ – ১,৫০,০০০ টাকার মতো হতে পারে (থাকা, খাবার, যাতায়াত ইত্যাদি মিলিয়ে)।
এই খরচগুলো প্রাথমিক ধারণা হিসেবে দেওয়া হয়েছে এবং সময় এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে।
রোমানিয়া ভিসা কি চালু আছে
হ্যাঁ, রোমানিয়া ভিসা বর্তমানে চালু রয়েছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে, বাংলাদেশি নাগরিকরা রোমানিয়ার ভিসার জন্য আবেদন করতে পারছেন। তবে বাংলাদেশে রোমানিয়ার কোনও স্থায়ী দূতাবাস নেই, তাই ভিসার জন্য আপনাকে রোমানিয়ার দূতাবাসের সাথে যুক্ত নির্দিষ্ট কিছু স্থানে যেতে হবে, যেমন ভারতের নিউ দিল্লি, ভিয়েতনাম, বা থাইল্যান্ড। সেখানে ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
বিশেষ করে ছাত্র ও কর্মসংস্থান ভিত্তিক ভিসার জন্য রোমানিয়া যথেষ্ট আগ্রহী, এবং সাম্প্রতিক সময়ে তারা অনেক বাংলাদেশি নাগরিককে ভিসা প্রদান করেছে। ২০২৩ এবং ২০২৪ সালের মধ্যে তারা কাজ এবং ছাত্র ভিসার জন্য একাধিক বারাজুরি কনস্যুলার মিশনও পরিচালনা করেছে।
ভিসা আবেদন প্রক্রিয়ার সময়কাল সাধারণত ৭ থেকে ৩০ কার্যদিবস পর্যন্ত হতে পারে। আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করতে হলে আপনাকে রোমানিয়ান দূতাবাসের ওয়েবসাইট থেকে ফর্ম পূরণ করে, প্রয়োজনীয় নথি সহ আবেদন করতে হবে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস
- ভিসার আবেদন করার আগে সব কাগজপত্র যাচাই করে নিন যাতে কোনো ভুল না হয়।
- ভিসার সাক্ষাৎকারের জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য নিয়ে প্রস্তুত থাকুন।
- ভ্রমণের আগে রোমানিয়ার বর্তমান আইন ও নিয়ম সম্পর্কে জানুন।
দরকারী লিঙ্ক:
- রোমানিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়: https://www.mae.ro/en
- রোমানিয়ার জাতীয় ভিসা পোর্টাল: https://evisa.mae.ro/
উপসংহার
রোমানিয়া ভিসা পাওয়ার প্রক্রিয়াটি সহজ হলেও প্রতিটি ধাপ সাবধানে অনুসরণ করা প্রয়োজন। সঠিক কাগজপত্র ও তথ্য প্রদান করলে আপনার ভিসা আবেদন দ্রুত প্রক্রিয়াকরণ হবে এবং আপনার যাত্রা সহজ হবে। ভিসা সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য ও আপডেট জানতে দূতাবাসের ওয়েবসাইট পরিদর্শন করতে ভুলবেন না।
আমি Nihal, একজন অভিজ্ঞ ভ্রমণ লেখক এবং ব্লগার। ভ্রমণের প্রতি আমার অদম্য আগ্রহ এবং বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার আকাঙ্ক্ষা আমাকে ভ্রমণ ও ভিসা বিষয়ক লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ করে। আমি বিভিন্ন দেশের ভিসা প্রক্রিয়া, ভ্রমণ টিপস এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখি। আমার লেখার মূল লক্ষ্য হলো পাঠকদের সঠিক তথ্য প্রদান এবং ভ্রমণকে আরও সহজ ও উপভোগ্য করে তোলা।